প্রতিদ্বন্দ্বিতা না প্রতিহিংসা ? সাংবাদিকতায় বেড়েছে অনাস্থা
আওরঙ্গজেব কামাল : বর্তমানে দেশে সাংবাদিকতায় প্রতিদ্বন্দ্বিতার চেয়ে প্রতিহিংসা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। যে কারনে সাংবাদিকতায় বেড়েছে ব্যাপক অনাস্থা। গত ১৫-২০ বছরে সাংবাদিকতাকে দুর্বৃত্তায়নে পরিণত করা হয়েছে শুধু মাত্র রাজনৈতিক ও প্রতিহিংসায়। প্রতিনিয়ত আদর্শিক কারণে সাংবাদিকের চাকরি হারাতে হচ্ছে। আজ সাংবাদিকরা সাংবাদিদের শত্রুতে পরিনত হয়েছে। এ অবস্থায় সাংবাদিকরা নিজেরাই নিজেদের স্বার্থ হাসিলে ব্যাস্ত সময় পার করছে । প্রতিদ্বন্দ্বিতা না প্রতিহিংসা? সাংবাদিকতায় বাড়ছে অনাস্থা। সাংবাদিকতা একটি মহান পেশা—এটি শুধু তথ্য জানানোর মাধ্যম নয়, বরং গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ, জনগণের কণ্ঠস্বর এবং রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। কিন্তু দুঃখজনকভাবে আজ এই মহান পেশাটিই বিভ্রান্তির, বিশৃঙ্খলার ও অনাস্থার আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। সাংবাদিকতা যেখানে গঠনমূলক প্রতিদ্বন্দ্বিতার জায়গা হতে পারত, সেখানে এখন রাজত্ব করছে প্রতিহিংসা। আর এই প্রতিহিংসাই জন্ম দিচ্ছে পেশার প্রতি সাধারণ

মানুষের গভীর অনাস্থা। বর্তমানে দেশের সাংবাদিক সমাজ একটি বিভক্ত এবং দুর্বল বাস্তবতার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছে। সাংবাদিকদের একটি অংশ নির্লোভ, নীতিনিষ্ঠ ও আদর্শবাদী হলেও, অন্য অংশটি চাটুকারিতা, দালালি এবং আর্থিক সুবিধা অর্জনের পথেই বেশি মনোযোগী। এই বৈষম্যের ফলে প্রকৃত সাংবাদিকেরা আজ কোণঠাসা; তাদের পায়ে জুতা নেই, পেটে ভাত নেই,পকেটে টাকে নেই, কণ্ঠে উচ্চারণের সাহস নেই। অন্যদিকে, সুবিধাবাদী কিছু ‘সাংবাদিক’বেশী দালাল বিলাসবহুল জীবনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন ক্ষমতার ছত্রছায়ায়। বর্তমানে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে নয়, অনেকেই আজ সাংবাদিকতাকে ব্যবহার করছেন নিজস্ব স্বার্থ হাসিলের হাতিয়ার হিসেবে। কেউ কেউ একটি ফেসবুক পেজ খুলে কিংবা একটি অনলাইন ওয়েবসাইট বানিয়েই নিজেকে সাংবাদিক পরিচয়ে দাবি করছেন। পেশাদারিত্ব, বস্তুনিষ্ঠতা, নৈতিকতা—এসব শব্দ আজ অনেক ক্ষেত্রেই শুধু কাগজে-কলমে রয়ে গেছে। অমি অনলাইনপত্রিকার বিপক্ষে বলছি না। যারা প্রকৃত ভাবে অনলাইনে কাজ করছে তাদের বিরুদ্ধে বলছি না। বলছি যারা সাংবাদিকতার যোগ্যতা রাখেনা তাদের কথা। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো—সাংবাদিকদের মধ্যেই আজ দেখা যাচ্ছে শত্রুতা, হিংসা এবং একে অপরকে নিচে টেনে নামানোর প্রবণতা। আর এ ক্ষেত্রে সিনিয়র জুনিয়র সকলের মধ্যে এই প্রবনতা কাজ করছে। সাংবাদিক সংগঠন গুলি খণ্ডে খণ্ডে বিভক্ত হচ্ছে। অনেকে নিজেই নিজেকে নেতা দাবী করে সাংবাদিকতাকে প্রশ্ন বৃদ্ধ করছে। এমন ও সাংবাদিক সংগঠন রয়েছে যার হাতে গোনা সদস্য কয়েক জন মাত্র তাও আবার সাংবাদিকদের মান তো বুঝতেই পারছেন। অনেক সাংবাদিক নেতা এখনো সাংবাদিকতা বিষয়ে কিছু জানেন না। নিজের নাম লিখতে ভুল করেন। নিউজের কথা না হয় বাদ দিলাম। বর্তমানে অনুসন্ধান করতে যাওয়া সাংবাদিককে বাধা দিচ্ছেন একই পেশার সহকর্মী, শুধুমাত্র নিজের গুরুত্ব বাড়ানোর জন্য। একই পত্রিকায় কাজ করেও সহকর্মীদের প্রতি আস্থা ও শ্রদ্ধাবোধ নেই। ফলে সত্য সংবাদও আজ প্রশ্নবিদ্ধ। রাজনৈতিক সমস্যা তো লেগেই আছে। আমরা ভুলে যাচ্ছি—গণমাধ্যম বন্ধ মানেই জনগণের চোখ বন্ধ, রাষ্ট্রের বিবেক নিস্তব্ধ। অথচ সাংবাদিকদের মধ্যকার এই অনৈক্য ও প্রতিহিংসা শুধু ব্যক্তিগত ক্ষতিই করছে না, গোটা পেশাকে করছে দুর্বল এবং সমাজে অবিশ্বাস্য করে তুলছে। আজ যে সাংবাদিকরা ‘সংবাদযোদ্ধা’ হিসেবে দুর্নীতি, অনিয়ম, অপরাধের বিরুদ্ধে কলম ধরছেন, তারাই বারবার শিকার হচ্ছেন হয়রানি, নিপীড়ন এবং একঘরে হওয়ার। অন্যদিকে, যারা পেশাটিকে অর্থ উপার্জনের মাধ্যম বানিয়ে ফেলেছেন, যারা পুলিশের দালালি করছেন,তারাই এখন সাংবাদিক সমাজে প্রভাব বিস্তার করছেন—যার ফলে প্রকৃত সাংবাদিকেরা হারিয়ে যাচ্ছেন আড়ালে। একটি রাষ্ট্রের সুস্থ গণতন্ত্র চর্চায় একটি স্বাধীন, নির্ভীক এবং আদর্শভিত্তিক গণমাধ্যম অপরিহার্য। কিন্তু রাষ্ট্র যখন সাংবাদিকদের কথা শোনে না, যখন সাংবাদিকরাই একে অপরের পেছনে ছুরি চালাতে ব্যস্ত, তখন প্রশ্ন ওঠে—সাংবাদিকতা কোথায় দাঁড়িয়ে আছে? এই অবস্থার জন্য শুধু রাষ্ট্র বা সরকার দায়ী নয়, দায়ী আমরা নিজেরাও। সাংবাদিকতা আজ নিজের অস্তিত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করছে—এই যুদ্ধ অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার, বিশ্বাস ফিরিয়ে আনার, মর্যাদা পুনরুদ্ধারের। এর একমাত্র পথ পেশাদারিত্ব, ঐক্য এবং নৈতিকতার বিজয়। আমরা মনে করি—সময় এসেছে আত্মসমালোচনার। সময় এসেছে প্রশ্ন তোলার—
কেন সাংবাদিকতার প্রতি আস্থা হারাচ্ছে মানুষ? কেন একজন সাংবাদিক অপর সাংবাদিকের শত্রু হয়ে উঠছেন?
কেন পেশাটিতে পেশাদার নয়, বহিরাগতদের দৌরাত্ম্য বাড়ছে? কেন অশিক্ষিতরা এই পেশায় ঢুকে পড়ছে?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে আমাদেরই। নইলে সাংবাদিকতা শুধু প্রতিহিংসার শিকার নয়, একদিন হয়তো এই পেশার অস্তিত্বও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়বে। তাই এখনই প্রয়োজন— পেশার প্রতি দায়বদ্ধতার, আদর্শের প্রতি অনমনীয়তা, এবং সর্বোপরি, সাংবাদিকদের মধ্যে ঐক্য। শুধু তাহলেই আমরা প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে সম্মানজনক রূপে ফিরিয়ে আনতে পারব, প্রতিহিংসার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে পেশাটিকে করতে পারব আবারও গৌরবময়।
বর্তমানে বাংলাদেশের সাংবাদিকতা একটি সংকটকাল পার করছে। এক সময় যেখানে এই পেশাকে বিবেচনা করা হতো সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার এবং রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে, সেখানে আজ সেটি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। একদিকে পেশাদার সাংবাদিকরা বঞ্চনার শিকার, অন্যদিকে কিছু সুবিধাবাদী ও অনুপ্রবেশকারী এই মহৎ পেশাটিকে কলঙ্কিত করে তুলছে। সাংবাদিকতায় আজ আর প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই, বরং প্রতিহিংসা ছড়াচ্ছে অজস্র শিকড় বিস্তার করে। এক সাংবাদিক অন্য সাংবাদিকের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে শুধুমাত্র ব্যক্তি স্বার্থে। এতে ভেঙে পড়ছে সংহতি, কমছে পেশার প্রতি শ্রদ্ধা, বাড়ছে গণমাধ্যমের প্রতি জনসাধারণের অনাস্থা। গত দুই দশকে সাংবাদিকতা ধীরে ধীরে এক দুর্বৃত্তায়নের পথে এগিয়েছে। রাজনীতি ও ব্যক্তিগত স্বার্থের দাপটে বহু গুণী, আদর্শনিষ্ঠ সাংবাদিক হারিয়ে গেছেন পেশার মঞ্চ থেকে। আদর্শের প্রশ্নে বহু সাংবাদিক চাকরি হারিয়েছেন, অন্যদিকে চাটুকারিতা ও ক্ষমতার দালালির মাধ্যমে কেউ কেউ অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন।এক পক্ষ আজও সংগ্রামী; তাদের হাতে সত্য প্রকাশের কলম, মুখে সাহসিকতার কথা। অন্য পক্ষ আত্মস্বার্থে নিমজ্জিত, ক্ষমতার লোভে নীতিহীনতায় ডুবে আছে। বর্তমানে এমন একটি অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে যেখানে সাংবাদিকরাই নিজেদের সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ। একই সংবাদপত্র বা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সাংবাদিকরাও একে অপরের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছেন। এতে শুধু ব্যক্তিগত ক্ষতি নয়, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পুরো গণমাধ্যম পেশা। অথচ এই বিভাজনের সুযোগ নিচ্ছে বহিরাগত স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী এবং গণমাধ্যমবিরোধী শক্তিগুলো। অনেক সময় দেখা যায়, অপরাধ অনুসন্ধানে যাওয়া সাংবাদিককেই হয়রানি করছে একই পেশার কেউ, শুধুমাত্র নিজেকে জাহির করার জন্য। এতে সঠিক তথ্য অনুসন্ধান অসম্ভব হয়ে ওঠে। সাংবাদিকদের মধ্যকার এই অনৈক্য গণমাধ্যমকে করছে দুর্বল ও অনির্ভরযোগ্য। এখন পত্রিকা বিক্রেতা, কম্পিউটার অপারেটর,প্রেসকর্মী, পত্রিকা অফিসের পিয়ন,গার্ড —এমনকি যারা কখনও সাংবাদিকতার প্রাথমিক প্রশিক্ষণও নেননি, তারাও সাংবাদিক পরিচয় ব্যবহার করছেন। এতে শুধু পেশার মর্যাদা ক্ষুণ্ন হচ্ছে না, পেশাজীবী সাংবাদিকদের সামাজিক অবস্থানও দিন দিন হেয়প্রতিপন্ন হচ্ছে। এই সব কারনে সংবাদমাধ্যম নিজেই নিজের সঙ্গে লড়াই করছে। একদিকে রয়েছে প্রথাগত সংবাদপত্র ও টেলিভিশন মিডিয়া,অন্যদিকে উত্থান হয়েছে অনলাইন নিউজ পোর্টালের এক বিশাল জগৎ। এই অনলাইন সাংবাদিকতার ব্যুমেরু বৃদ্ধি যেমন তথ্যপ্রবাহকে গতিশীল করেছে, তেমনি অনেক ক্ষেত্রে বস্তুনিষ্ঠতার অভাব ও ভিত্তিহীন তথ্য প্রকাশ সংবাদমাধ্যমের প্রতি আস্থাকে করেছে দুর্বল। প্রতিযোগিতা এখানে চরমে—সবাই চায় 'আগে' সংবাদ দিতে, কে আগে 'ভিউ' পাবে, সেটাই মুখ্য। ফলে, সত্য যাচাই কিংবা তথ্য নির্ভুলতা আজ বড় বিষয় নয় অনেকের জন্যই। সাংবাদিকতায় পেশাগত ঝুঁকি ও হতাশার চিত্র অমি প্রতিনিয়ত দেখতে পায়।সাংবাদিকতা নিঃসন্দেহে একটি বিপজ্জনক পেশা। সঠিক ও সত্য সংবাদ প্রচারের কারণে বহু সাংবাদিককে—
শারীরিক আক্রমণ,হুমকি,মামলা—এমনকি মৃত্যুর মুখেও পড়তে হয়েছে।বিপরীতে, প্রকৃত সাংবাদিকরা আজ সমাজে অবমূল্যায়িত। জাতির বিবেক আজ নিঃস্ব ও অবহেলিত হচ্ছে। সাংবাদিক নিজেই সাংবাদে পরিনত হচ্ছে। দেশে সাংবাদিকদের নিয়ে মব তৈরী হচ্ছে। যেনম স্বৈরাচারমুক্ত সুবিধাবাদ বিরোধী নামের ভুয়া ফেসবুসহ অনেক ফেসবুক পেজে প্রকৃত সাংবাদিদের বিরুদ্ধে একের পর একের বানোয়াট তথ্য ও বিগত সরকার দলীয় মন্ত্রী এমপিদের ছবিযুক্ত করে হয়রানী করছে। এ বিষয়ে বহু পত্রপত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হলেও কোন ফল পায়নি সাংবাদিক সমাজ। অবাধ তথ্যপ্রবাহের যুগে সাংবাদিকদের নিরাপত্তা, মর্যাদা ও পেশাগত স্বীকৃতি নিশ্চিত করা না গেলে, গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচারের ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়বে। তাই আমার সরকারের কাছে দাবী সাংবাদিকদের নিরাপত্তা দিন । এ সব ভূয়া ফেসবুক ব্যবহারকারীদের খুজে বের করে আইনের আওয়াতায় আনতে হবে। বর্তমানে সাংবাদিকতার এই অন্ধকার পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন—সাংবাদিকদের মধ্যে ঐক্য। পেশাগত নৈতিকতা ও বস্তুনিষ্ঠতায় অটল থাকা বহিরাগতদের হাত থেকে পেশাকে রক্ষা করা
সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে সাংবাদিকদের পেশাগত সুরক্ষা নিশ্চিত করা। মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সাংবাদিকতা পরিহার করা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সাংবাদিকতার মহৎ চেতনাকে ফিরিয়ে আনতে হবে—সততা, সাহসিকতা, পেশাদারিত্ব ও জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা। এ যুদ্ধ জয় করতে হলে সাংবাদিকদের নিজেরাই হতে হবে নিজের শক্তি, নিজের অভিভাবক। প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকুক, কিন্তু তা যেন হয় গঠনমূলক ও ইতিবাচক। প্রতিহিংসা নয়, প্রয়োজন সহমর্মিতা ও পেশাদারিত্ব। গণমাধ্যমের প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে, সাংবাদিকদের আগে নিজেদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে নিজেদের প্রতি।
লেখক ও গবেষকঃ
আওরঙ্গজেব কামাল
সভাপতিঃ ঢাকা প্রেস ক্লাব